দেড় দশকে নাগরিকদের ন্যূনতম মানবাধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছিল : এটর্নি জেনারেল

দেড় দশকে নাগরিকদের ন্যূনতম মানবাধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছিল : এটর্নি জেনারেল

 

পঙ্​ক্তি ডেস্কঃ

এটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, বিগত দেড় দশক ধরে খুন, গুম, হামলা, মামলা, দমনপীড়ন ও লুটপাটের মাধ্যমে নাগরিকদের ন্যূনতম মানবাধিকার কিংবা ভোটের অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল।
সারাদেশের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের দেয়া অভিভাষণ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় এটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এ কথা বলেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা। অভিভাষণ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল।
এটর্নি জেনারেল বলেন, বিগত সময়ে যেসব বিচারক ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে মানুষের অধিকার হরণে ভূমিকা পালন করেছেন, তারা এখনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। এ বিষয় চলমান থাকলে জাতির কাছে ভুল বার্তা যাবে।
তিনি বলেন, দেশী ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) পর্যন্ত চার হাজারেরও বেশি মানুষ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। ৭শ’র বেশি মানুষ গুমের শিকার হয়েছে। ৬০ লক্ষাধিক মানুষ গায়েবি মামলার আসামি হয়েছিল। কথা বলার স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের স্বাধীন ও মৌলিক অধিকারগুলো হরণের মাধ্যমে বিরোধী মত দমনের নিকৃষ্টতম ইতিহাস রচিত হয়েছিল।
তিনি বলেন, সেই দুঃসময়ে আমাদের বিচার বিভাগ ন্যায়বিচারের ধারা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। হয় দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন, নয়তো নতজানু অবস্থান নিয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। যা আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি। আপনারা জেনে আনন্দিত হবেন, ৩৬ জুলাই থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কেউ বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়নি। তার মূল কৃতিত্ব যেতে পারে আমাদের শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক আসিফ নজরুলের নেতৃত্বের প্রতি।
এটর্নি জেনারেল আরও বলেন, মামলা দায়েরে ভিকটিম ফ্যামিলি কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনের গ-ি অতিক্রম করেছে বলে আমরা লক্ষ্য করেছি। এ বিষয়ে আমি উদ্যোগ নিয়ে জনমনে ভীতি দূর করতে সরকারের কাছে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেছিলাম আমার অফিস থেকে। তার একটি ছিল মামলা হওয়া মানেই গ্রেফতার নয়। এর ফলে জনমনে অনেক স্বস্তি ফিরে এসেছে ইতোমধ্যেই।
তিনি বলেন, বিচার বিভাগের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দুর্নীতি। যা অর্থনৈতিক কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি হতে পারে। জাতি প্রত্যাশা করে, বিচার বিভাগ যেকোনো ধরনের দুর্নীতি কিংবা সিন্ডিকেটমুক্ত থাক। দুর্নীতির প্রচলিত ধারণা অর্থনৈতিক লেনদেন বুঝালেও, বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি ডিনামাইটের চেয়েও ধ্বংসাত্মক। অ্যাটম বোমার চেয়েও ভয়াবহ। ক্যানসারের চেয়েও মারণঘাতী। সুতরাং শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে বিচার বিভাগের সব স্তর থেকে দুর্নীতি দূরীকরণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নৈতিক দায়িত্ব ও বড় চ্যালেঞ্জ বলে আমি বিশ্বাস করি।
এটর্নি জেনারেল বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, বিগত সময়ে যেসব বিচারক ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে মানুষের অধিকার হরণে ভূমিকা পালন করেছেন, তারা এখনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ পদে (পোস্টিং) রয়েছেন। এ বিষয় চলমান থাকলে জাতির কাছে ভুল বার্তা যাবে। আইন উপদেষ্টা ও প্রধান বিচারপতির অফিসকে এ বিষয়ে যথাযথ সতর্ক থাকার জন্য বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বিচারকদের প্রয়োজনীয় সমস্যা দূরীকরণেও আইন উপদেষ্টা ও প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা।
এটর্নি জেনারেল বলেন, অসংখ্য ছাত্র জনতার অসীম ত্যাগের ফসল আজকের সরকার। এ সরকার কোন রাজনৈতিক দলের সরকার নয়। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সকল মানুষের সরকার বর্তমান সরকার। আজকে আমরা রাষ্ট্র গঠন ও সংস্কারে যে চিন্তা করছি সেটি দেড় মাস আগেও কল্পনা করা যেত না।
এটর্নি জেনারেল বলেন, জুলাই আগস্টের ৩৬ দিনের আন্দোলনে ১৪৩০ জন শহিদ, ২২ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। ৫৮৭ জনকে পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন এসেছে।
এটর্নি জেনারেল বলেন, বিচার বিভাগ সংস্কারের জন্য একটি কমিশন করা হয়েছে। সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান করা হয়েছে বিচার বিভাগের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব আপিল বিভাগের প্রাক্তন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানকে।
এটর্নি জেনারেল বলেন, বিচারকরা স্বাধীন ও সার্বভৌম এটি তাদেরকে মনে করতে হবে এবং ধারণ করতে হবে। জাতি প্রত্যাশা করে বিচার বিভাগ যে কোনো দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট মুক্ত থাকবে।
সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিচারকদের পক্ষ থেকে বক্তৃতা রাখেন নওগাঁর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিশ্বনাথ মন্ডল ও খুলনার জেলা ও দায়রা জজ মাহমুদা খাতুন। তারা দেশব্যাপী নি¤œ আদালতে বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন। পাশাপাশি সংস্কারের পরামর্শও তুলে ধরেন। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বিচারপতি, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান আপিল বিভাগের প্রাক্তন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, এটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম রব্বানী, সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির কর্মকর্তা ও সারাদেশ থেকে আসা দুই হাজার বিচারক উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান বিচারপতি অভিভাষণে বিচার বিভাগের জন্য একটি রোডম্যাপ তুলে ধরেন।

Share This