আন্দোলন, আগস্ট ও আগামীর শঙ্কা
শেখ নূর কুতুবুল আলম
আজ আগস্ট মাসের প্রথম দিন। বাঙালি জাতির পিতা, এ জাতির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের শিকার হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। তার সাথে তার স্ত্রী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব , তিন পুত্র- শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল ও দুই পুত্রবধুসহ বেশকয়েকজন স্বজনকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। গভীর শ্রদ্ধার সাথে সবাইকে স্মরণ করছি। তাদের সবার পরকালীন শান্তি কামনা করছি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে নৌ- বহর পাঠানো বিশ্বমোড়ল সবসময়ই বাংলাদেশ কে পাখির চোখ করে রেখেছে। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট এর ঘটনার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ঘটনায় তাদের অবস্থান অনুসন্ধান করলে যা পাওয়া যায় আজও তারা সেই অবস্থানে এসে দাড়িয়েছে। তাদের প্রচেষ্টা থেমে নেই। বিশ্বে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ যে দেশের নেতাই বিশ্বমঞ্চে গুরুত্ব অর্জন করতে শুরু করেছেন, যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ তাদের দাসখত না দিয়ে বা বশ্যতা স্বীকার না করে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে এগিয়ে চলার চেষ্টায় সফল হয়েছে সেই দেশকে,সেই দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান কে তারা বিভিন্ন অজুহাতে আক্রমন করেছে এবং তাদের পছন্দের পুতুল সরকার বসিয়ে লুটপাট করে তাদের স্বার্থ শতভাগ নিশ্চিত করেছে । লিবিয়া, মিসর, তিউনিসিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনে তারা এদেশগুলোতে আক্রমণ করেছিল তাদের সে অভিযোগের সত্যতা কতটুকু পাওয়া গেছে সে বিষয়ে বিশ্বের সচেতন মানুষ অবগত আছেন। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে রাশিয়া ও ইরান ব্যাপক সাপোর্ট দেয়ায় তিনি এখনো টিকে আছেন বটে কিন্তু তার দেশ ভালো নেই। আফগানিস্তানের সাথে দীর্ঘ লড়াইয়ে তারা শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের ক্ষতি মেনে নিয়ে সে দেশ ত্যাগ করেছে। তালিবান সরকার সে দেশের দায়িত্বভার গ্রহন করে নতুন উদ্যমে ঘুরে দাড়িয়েছে। এখন আর তাদেরকে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদিতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয় না কারণ এখন সেখানে তাদের দৃষ্টি বা ফোকাস নেই। ইদানীং বাংলাদেশের সবকিছু নিয়ে বিশ্বমোড়ল খুব উদ্বেগ প্রকাশ করে, সবকিছু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে। তারা যে দেশকে নিয়ে মাথাব্যথা দেখায় বুঝতে হবে সে দেশের স্বার্থে বা কল্যাণে নয় বরং তাদের নিজস্ব বড় ধরনের টার্গেট আছে, বড় ধরনের স্বার্থ আছে। ইসরায়েলের সামরিক হামলায় ফিলিস্তিনের হাজার হাজার নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষ মারা গেলেও সেখানে যুদ্ধ বন্ধ করতে কার্যকর কোন পদক্ষেপ বিশ্ব মোড়ল নিচ্ছে না। আমরা যারা স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং ফিলিস্তিন ইসরায়েলের মধ্যে স্থায়ী শান্তির পক্ষে তারা কী ইসরায়েলের সাথে বিশ্বমোড়লের এই অমানবিক বন্ধুত্ব অস্বীকার করতে পারি? ফিলিস্তিন- ইস্যুতে যারা ফেসবুক প্রোফাইলে ফিলিস্তিনের পতাকা দেন, তাদের কেউ কোনভাবেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিশ্বমোড়লের হস্তক্ষেপে খুশি হতে পারেননা। পৃথিবীজুড়ে যেখানে পরাশক্তির স্বার্থ আছে সেখানে তারা শুরুতেই হামলা করেনি, বিদ্যমান সরকার বা রাষ্ট্র কাঠামোকে বিভিন্নভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করেছে, যেসব রাষ্ট্রের সরকার তাদের বশ্যতা শতভাগ মেনে নিয়েছে তাদের সাথে গলায় গলায় বন্ধুত্ব আর সেসব রাষ্ট্রের সরকার বা কোন রাষ্ট্রনায়ক তাদের নিজ রাষ্ট্রের স্বার্থের বাইরে গিয়ে শুধুমাত্র ক্ষমতার আসন পোক্ত করতে মোড়লের সাথে করমর্দন করেনি তাদের কে বিভিন্নভাবে ধাক্কা দিয়েছে। তারা সেই দেশ বা দেশের সরকার প্রধানকে ফেলে দিয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে ও তার সরকারকেও ফেলে দিয়েছিল প্রায় কিন্তু তিনি ঘুরে দাড়িয়েছেন। পাকিস্তানের তেহরিক ই ইনসাফ (পিটিআই) দলের প্রধান ও পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেও সরিয়ে দিয়েছে। এখন তাদের পূর্ণ মনোযোগ বাংলাদেশে।
শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর মেয়ে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি, বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনার প্রতি এদেশের মানুষের ভালবাসা আছে, বিশ্বাস আছে। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে রাজপথে তাকে হারানো সহজ নয়। কিন্তু ইদানীং তার দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন তাদের প্রতি দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বঞ্চনা ও অবমূল্যায়নের ক্ষোভ ও অসন্তোষ রয়েছে। তারা অভিমান করে মাঠে না নামায় উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ এমন একটি রাজনৈতিক দল যারা দুর্যোগ, দুঃসময় ও সংকটে ঘুরে দাড়িয়েছে বারবার। এবারও সেই চেষ্টা করে যাচ্ছে। গত পনের বছর একটানা ক্ষমতায় থাকায় সংগঠনের কাঠামো শক্তিশালী করার প্রতি দলটির মনোযোগের ঘাটতি সুস্পষ্ট। ক্ষমতার সুবিধা নিতে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী আদর্শের ছিটেফোঁটাও ধারণ করেনা এমন অসংখ্য লোক এই দলে অনুপ্রবেশ করে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে দলটিকে সমালোচিত ও বিব্রত করেছে। এরা সুস্থ দেহের বাড়তি মেদ এর মতো। আওয়ামী লীগ যদি এই মেদ ঝরাতে না পারে তাহলে রোগাক্রান্ত হয়ে দীর্ঘস্থায়ী সংকটে পড়তে হবে। আওয়ামী লীগ বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়, আওয়ামী লীগ কোন বেনিয়া গোষ্ঠী নয়। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ নেতৃত্ব দান কারী গণমানুষের দল। গনবিরোধী কোন কর্মকাণ্ডের সাথে এ দলের কোন পর্যায়ের কারো সম্পৃক্ততা লজ্জাজনক।
আওয়ামী লীগ এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন – “আওয়ামী লীগ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, আওয়ামী লীগ একটি অনুভুতির নাম, আওয়ামী লীগ একটি পরিবার।”
সৈয়দ আশরাফের সেই অনুভূতি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুভূতি, জাতীয় চারনেতার আত্মত্যাগের অনুভূতি, মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লক্ষ লক্ষ মা – বোনের অবদানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অনুভূতি।
বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বজায় থাকায় বাংলাদেশে সরাসরি আক্রমণ করার মত বোকামি বিশ্বমোড়ল করতে যাবে না। কৌশলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ভারতকেও অস্বস্তিতে রাখবে। কারণ বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকা না থাকার সাথে ভারতের নিরাপত্তা জনিত স্বার্থ রয়েছে। ভারত চায় বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীল অবস্থা। এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারত বিরোধী মনোভাবের একটা বড় জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা সেই বিশ্বমোড়লের যেমন রয়েছে তেমনি সীমান্ত হত্যা ও পানিবণ্টন চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়া সহ কিছু কিছু বিষয়ে ভারত বিরোধী মনোভাব কে উস্কে দিয়েছে। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন থেকে শুরু করে আজ অবধি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিরাজমান দ্বিপাক্ষিক সুসম্পর্ক উভয় দেশের জন্য প্রয়োজনীয় ও অনিবার্য সেটি বিভিন্নভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
এখন আসি মূলকথায়। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের চলমান কোটা বিরোধী আন্দোলন / বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। শুরুতে এটা নিয়ে কেউ সেভাবে গুরুত্ব না দেয়ায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করার সুযোগ পেয়েছে। পরাশক্তির দৃষ্টিতেও বিষয়টি এড়ায়নি। সরকার একটু দেরিতে হলেও নড়েচড়ে বসে এ বিষয়ে যৌক্তিক সমাধান করতে উদ্যোগী ও আন্তরিক হয়েছে কিন্তু ততক্ষণে বল বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের কোর্টে এবং তারা যথেষ্ট স্পেস পেয়ে আন্দোলনের ধারাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ দিতে সচেষ্ট হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে বেশকিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেছে যা সামগ্রিক পরিস্থিতি কে জটিল করে তুলেছে। শেষ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সিভিল প্রশাসন, বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও সর্বশেষ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এ বিষয়ে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে সহিংসতা বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে মানুষের প্রাণহানি, হতাহত ও রক্তপাতসহ রাষ্ট্রের ক্ষতি হাজার কোটি টাকার সম্পদ । ভৌত অবকাঠামোর ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে হয়তো সময় লাগবে কিন্তু সহিংসতায় হারানো প্রাণ আর ফিরে পাওয়া যাবে না। এরজন্য সবার ধৈর্য্য ধারণ করা প্রয়োজন। কারণ বিপদ কেটে যায় নি। যারা সরকার পতনের আন্দোলনের সাথে যুক্ত তারা তারা যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে একথা সত্য কিন্তু এভাবে সরকার পতন এতটা সহজও নয় কাম্য নয়। আর তাছাড়া সরকার বা ক্ষমতার পালাবদল হলেও চলমান আন্দোলনের সাথে যুক্ত শিক্ষার্থীদের বা রাজনৈতিক দলসমূহের খুব বেশি লাভের কোন সম্ভাবনা দেখি না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতায় কে বসবে কে বসবে না এটা যেমন বিদেশি শক্তির দ্বারা পুরোপুরি নির্ধারণ করা সহজ নয়। আবার বর্তমান প্রেক্ষিতে তাদের পছন্দের তালিকায় বিদ্যমান কোন রাজনৈতিক দল নেই। তারা তৃতীয় কোন গ্রুপকে শক্তিশালী করে তাদেরকে ক্ষমতায় বসাতে চায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতায় তৃতীয় কোন শক্তি আসাটাও দুশ্চিন্তার কারন নয় যতটা দুশ্চিন্তার কারণ বিশ্বমোড়ল সৃষ্ট পুতুল সরকার ধারণা। বাংলাদেশের জনগণ সে পথে পা বাড়াতে পারে না। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।