বিজয়ের জন্য সংগ্রাম : জাফর ওয়াজেদ
জাফর ওয়াজেদ
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বকণ্ঠে এই ঘোষণা প্রদানের পর দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন, ‘পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’
জনগণ সেই ডাকে সাড়া দিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এই ঘোষণা প্রদানের একমাত্র অধিকার ছিল বঙ্গবন্ধুর, যা জাতি সত্তরের নির্বাচনে সেই ক্ষমতা প্রদান করেছিল। বাংলাদেশের জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছা-আকাক্ষার ধারকে পরিণত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে। যে জাতীয় চেতনার উন্মেষের ফলে আমাদের সময়কালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটেছে, সেই জাতীয় চেতনার উন্মেষের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অবদান অবিস্মরণীয়। পাকিস্তান নামক ‘অদ্ভুতুড়ে’ রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাস করে তিনি তার জাতিকে ধাপে ধাপে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সহস্র বছরের মধ্যে বাঙালির ওই প্রথম গণজাগরণ ঘটেছিল একাত্তর সালে এসে।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর শাসনক্ষমতা মুসলিম লীগের পাকিস্তানিপন্থিদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। মুসলিম লীগের বাঙালিরা হয়ে পড়ে তাদের তল্পিবাহক। বাঙালি জাতি হয়ে পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণির প্রজা। শোষণের ভারে জর্জরিত ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে দুই টুকরো করার পর ভারত গণতান্ত্রিক পথে পরিচালিত হতে থাকে। কিন্তু পাকিস্তান হয়ে পড়ে গোলমেলে এক রাষ্ট্র। কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হলো না চালু। বিফলে গেল সংবিধান প্রণয়নের নানা প্রচেষ্টাও। বিরোধী পক্ষের কণ্ঠরোধ, যথাসময়ে নির্বাচন আয়োজনও সম্পন্ন করা হয়নি। দেশভাগ পূর্ববর্তী অখণ্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বিতাড়িত জীবনযাপনে বাধ্য করা হয়েছিল।
সোহরাওয়ার্দীর জীবনাবসানের পর তার দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের দায়িত্ব বর্তায় তরুণ নেতা শেখ মুজিবুরের ওপর। মওলানা ভাসানীসহ আরও কতিপয় ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসা দলছুটরা গঠন করেছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয় বাস্তবতার নিরিখে, অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলোকে। দলটি দ্রুত শক্তি সয়ে হয়ে ওঠে সক্ষম। সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব সাহসী ও অক্লান্ত কর্মী হিসেবে নিজেকে প্রমাণিত করে সারা দেশে সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৫৪ সালে এরা সবাই জোটবদ্ধ হয়ে প্রাদেশিক যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে লড়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন প্রবীণ নেতা শেরেবাংলা। নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট এবং মুসলিম লীগের ভাগ্যে জুটেছিল ধস নামানো পরাজয়। পূর্ব বাংলার বাঙালিরা মুছে দিয়েছিল মুসলিম লীগের অস্তিত্ব।
সেই সঙ্গে ক্ষমতা ও ন্যায়ভিত্তিক সংস্কারের দাবি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠেছিল ক্রমশ প্রতিদিন, পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা রাজনৈতিক মীমাংসার পথে না গিয়ে ছয় দফার দাবিদার শেখ মুজিবকে কার্যত আইনের অস্ত্রে ঘায়েল করতে চেয়েছিল। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চক্রান্তের দায়ে দায়ের করা কথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিব হলেন প্রধান অভিযুক্ত। বাংলার বাঙালি এটাকে দেখল মুজিবের বিরুদ্ধেই শুধু চক্রান্ত নয়, বাঙালি জাতিকে আরও নিষ্পেষিত, কণ্ঠরোধ করা, অধিকারহীন অবস্থানে নিয়ে যাওয়ারও ষড়যন্ত্র। ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ হলো। তারা ছয় দফার আলোকে ঘোষণা করল ১১ দফা। গর্জে উঠল সারা বাংলা। সামরিক শাসক আইয়ুব খানের গদি টলমল। সারা পূর্ববাংলায় ছড়িয়ে পড়ে গণ-আন্দোলন। তার ঢেউ লাগে পাকিস্তানের সর্বত্রও। গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় আইয়ুব ১০ বছর টানা শাসন শেষে। তবে উত্তরসূরি হিসেবে সামরিক বাহিনীর প্রধান ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া শাসনভার গ্রহণের দুই বছরের মাথায় একাত্তরের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে গণহত্যা চালায়। ইয়াহিয়া ক্ষমতা নিয়ে বেতারে যে ভাষণ দেন, তাতে পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষার ওপরেই জোর দেন। বিশেষভাবে জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেন সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা। বাঙালি বুঝে নিল ক্ষমতা এক জেনারেল থেকে আরেক জেনারেলের হাতে পড়েছে। সামরিক শাসনমুক্ত হয়নি জাতি। বরং নতুন করে সামরিক ফরমান জারি শুরু হয়। ক্ষমতা দখল করে ইয়াহিয়া যে ভাষণ দেয়, তাতে বাঙালির কাছে স্পষ্ট হলো যে, আর একসঙ্গে থাকা যাবে না।
২৬ মার্চ থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের ভাবনাটা শেখ মুজিব তাঁর জনগণের মধ্যে সম্প্রসারিত করতে পেরেছিলেন। সামরিক আইনের কাঠামোর মধ্যে হলেও ইয়াহিয়া গণচাপে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হলো। সত্তরের ডিসেম্বরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু জনগণের কাছ থেকে ছয় দফা ইস্যুতে ম্যান্ডেন্ট পেলেন। আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এককভাবে সরকার গঠনের মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। শেখ মুজিব নির্বাচনকে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর তো হলোই না, শুরু হয় ভয়ংকর ষড়যন্ত্র। পাকিস্তানি শাসক সামরিক গোষ্ঠী জনগণের এ রায় আশা করেনি। তাই তারা তা মেনে নিতে গররাজি হয়ে ওঠে। জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডেকে তা আবার স্থগিত করে। বাঙালি এত বড় বিজয় নস্যাতের পাকিস্তানি অপচেষ্টার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ শুরু হয় সারা বাংলায়। এই প্রতিবাদ ছিল নজিরবিহীন। শহর-বন্দর-গ্রাম জেগে ওঠে স্বাধীনতার মহান লক্ষ্য সামনে রেখে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ রাজপথে নেমে আসে। ছাত্রসমাজ ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা জোরালো সংগ্রামের পথে ধাবিত হয়। সবকিছু অচল হয়ে পড়ে। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। সারা বাংলা তখন শেখ মুজিবের অঙ্গুলি হেলনে পরিচালিত হতে থাকে।
পাকিস্তানি শাসকদের অস্তিত্ব কেবল সেনাছাউনিতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম অব্যাহত রাখার দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। পূর্ববাংলার মানুষ স্বাধিকারের দাবিকে স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তরিত করে। দেশজুড়ে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে স্বাধীনতার পক্ষে। শুরু হয় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। ছাত্রছাত্রী, যুবা-যুবতী থেকে শুরু করে পেশাজীবীরাও অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিতে থাকে দেশের বিভিন্ন স্থানে। পহেলা মার্চের পর বাঙালি বুঝে নেয়, পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে কোনো মীমাংসা সম্ভব নয়। তারা স্বাধীনতার পথকেই বেছে নেয়। ইয়াহিয়া, ভুট্টোর সঙ্গে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনাকালে অনেকের মনে হয়েছে, রক্তপাত এড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীনতা পাওয়া যাবে। কিন্তু অধিকাংশ বাঙালি বুঝে নেয়, রক্তপাত ছাড়া স্বাধীনতা অর্জনের কোনো উপায় নেই। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ চলাকালে পাকিস্তানি বিমান ও হেলিকপ্টার সমাবেশস্থলের ওপর বারবার চক্কর দেয়। হামলার পরিকল্পনাও ছিল তাদের তখন।
আলোচনা অসমাপ্ত রেখেই রাতের অন্ধকারে গোপনে ইয়াহিয়া, ভুট্টো ঢাকা ত্যাগ করে। আর দেশটিকে এক নিষ্ঠুর সামরিক আগ্রাসনের মুখে ঠেলে দেয়। ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যরাতের তথাকথিত অপারেশন সার্চলাইট চালিয়ে গণহত্যা শুরু করে। বাঙালি আজও ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস স্মরণ করে আসছে। মহান নেতা শেখ মুজিব ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে স্বাধীনতার কঠিন অভিযাত্রায় সর্বাত্মক লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিলেন। পুরো জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই ডাক শুনে দখলদার হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে হঠাতে। সর্বত্র রুখে দাঁড়ায় বাংলার জনগণ।
নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর আক্রমণ তীব্রতর হতে থাকে। বাঙালি জড়িয়ে পড়ে এক অসম যুদ্ধে। যে যুদ্ধ পাকিস্তানি জান্তা চাপিয়ে দিয়েছে তাদের ওপর। পাকিস্তানি সেনারা নির্বিচারে গণহারে বাঙালি নিধনে মত্ত হয়ে ওঠে। রাস্তাঘাট, রিকশায়, গাড়িতে, ঘরে, বাড়িতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে, ছাত্রাবাসে এবং যানবাহনে বাঙালি নিধন পর্ব অব্যাহত রাখে হানাদাররা। শুরু হয় নারী জাতির ওপর নৃশংস অত্যাচার, ধর্ষণ। প্রকাশ্যে নারীর স্তন কেটে বেয়নেটের মাথায় নিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে হানাদার সেনারা। গ্রামগঞ্জে শহরে ধর্ষণের শিকার হতে থাকে নারী। বেয়নেটের ডগায় শিশুরা উড়তে থাকে রক্তাক্ত নিশানের মতো। অস্ত্র হাতে না ধরতে শেখা বাঙালি অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে থাকে বাঙালি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে।
মুক্তাঞ্চলে ১০ এপ্রিল গড়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রথম সরকার। সেই সরকারের অধীনে পরিচালিত হয় যুদ্ধ। সারা বাংলা তখন জেলখানা। হানাদার ও তার সহযোগী আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি, রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনীর সম্মিলনে সারা দেশ নরকে পরিণত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার জন্য বাঙালিদের করণীয় বিষয়ে ঘোষণা যেমন দেওয়া হতো, তেমনি পাকিস্তানিদের নিধনে জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে সর্বত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথাও বলা হতো। হানাদারদের অত্যাচারে দেশত্যাগে বাধ্য কোটিখানেক বাঙালি শরণার্থী সেদিন ভারতের মহানুভবতায় মাথা গোঁজার ঠাঁই এবং খাবার পেয়েছিল। বাঙালির সংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাসের এই হচ্ছে সার সংক্ষেপ। এর ভেতর কত শাখা, প্রশাখা, উপশাখা, ডালপালা বিস্তৃত রয়েছে যে, তার সবটুকু আজও জানা হয়নি সবার।
বাঙালি ইতিহাস সম্যক জাতি নয়, হলে তার রচিত ইতিহাস হতো সমৃদ্ধ এবং বিশ্বসেরা। কিন্তু আজ নানা বিকৃতি এসে ইতিহাসকে গ্রাস করতে চায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা হয়নি। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি-যা হয়েছে তা ব্যক্তিগত উদ্যোগে।
স্বাধীনতার তেপান্ন বছর পার করেছে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে ধূসর। পরাজিত শত্রুদের বাড়ছে আন্দোলন। পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারে সক্রিয়রা দেশে-বিদেশে চালাচ্ছে নানা ষড়যন্ত্র। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য মুক্তিকামী বাঙালির।
লেখক: একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)